ক্লিওপেট্রার সেক্স অ্যাপিল

সখীরা তাকে গোসল করিয়েছে মধু আর গাঁধার দুধে। ধর্মীয় রীতি মতো শিশুগন্ধ, পদ্ম, আর মধুমতীর পুষ্পমধু মাখানোর পর, তার নিরাভরণ শরীর শুইয়ে দেওয়া হয়েছে কোমল পালকে তৈরি সিল্কের বালিশে।

তার মুদিত চোখের পাতা যেন এক চিলতে ঘৃতকুমারীর ফালি। তার মুখে আর গ্রীবাদেশের প্রলেপ তৈরি হয়েছে ষাঁড়ের যকৃতের পাচক রস, উটপাখির ডিম আর মৌমাছির মোমে।

দিবা নিদ্রা থেকে যখন সে জেগে উঠলো, আকাশে চাঁদ তখন প্রায় মধ্যগগনে।

রাজসখীরা তার হাতযুগল সুরভিত করেছে গোলাপ সুগন্ধিতে আর পদযুগলে পড়েছে খুবানী আর কমলা ফুলের অমরত্বসুধা। তার নাসারন্ধ্র থেকে নির্গত নিঃশ্বাসে লেবু আর দারুচিনির সুবাস, মরু খর্জুরে সুমিষ্ট আর আখরোটের তেলে দীপ্তিময় তার কেশরাজি।

সমাসন্ন তার প্রসাধনের কাল। কাচপোকার চূর্ণে রঞ্জিত হলো তার কপোল আর অধর। ধাতুচূর্ণে আঁকা হলো তার ভ্রুযুগল। লাপিস লাজুলি আর মালাকাইটের রঞ্জকে চোখের চারপাশে তার ছড়িয়ে দেওয়া হলো নীলের হালকা আভা।

আলেকজান্দ্রিয়ার নিজ প্রাসাদে, ক্লিউপেট্রার অন্তিম রাত এটা।

এই বর্ননাটা ছিল  ক্লিওপেট্রার অন্তিম দিনের, যে ক্লিওপেট্রা ইতিহাসে পরিচিত ক্লিউপেট্রা (সপ্তম) ফিলোপাতর নামে, যার রাজত্বকাল ছিল যীশুখ্রিস্টের জন্মের দিকে ধাবমান শতকে, মিশরে।

ক্লিওপেট্রা কে নিয়ে প্রচলিত নানা কাহিনী, আর উপকথা দু’হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে, সামনে হয়তো আরও একশ বছর কিংবা অনন্তকালই টিকে থাকবে, এবং যার মূলে আছে ক্লিওপেট্রা নামের ওই নারীর বিমোহিত করা শরীরী সৌন্দর্য আর রূপমাধুর্য— যার কারণে তাকে সৌন্দর্য্যের দেবীর আসনে তুলে দেওয়া হয়েছে, তাঁকে নিয়ে যুগে যুগে কবি রচেছে স্তুতিকাব্য, যে অনুপ্রাণিত করেছে অগুন্তি সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, চিত্রকরকে। তার নামে দুনিয়াজোড়া নামকরণ হয়েছে অসংখ্য বিউটি পার্লার ও গণিকালয়ের।

কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে তৈরি হওয়া এসব গল্পগাথার মূলে আছে দুই গ্রিক শাসক ও বীর জুলিয়াস সিজার এবং মার্ক অ্যান্টনিকে তাঁর রূপ-মোহে বশ করার বিখ্যাত ঘটনা। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, প্রায় উপকথায় পরিণত হওয়া এই নারী কেমন ছিল আসলে দেখতে? তার অতুলনীয় যে শরীরী সৌন্দর্য বন্দনার বর্ণনা পাওয়া যায় তা কতখানি বাস্তব? দেখা যাক ইতিহাস ও প্রত্নতাত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ কী বলছে।

ক্লিওপেট্রার শাসনকালের প্রায় দুশত বছর পর, রোমান ঐতিহাসিক ক্যাসিয়াস দিও ক্লিওপেট্রার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন— ‘অতুলনীয় রপসী এক নারী’ যে একই সঙ্গে ‘বুদ্ধিদীপ্তও’। কিন্তু আরেকটু পিছিয়ে গেলে আরেক গ্রিক ঐতিহাসিক প্লুটার্ক, ক্যাসিয়াস দিওর প্রায় একশ বছর আগে লিখছেন: ‘তার সৌন্দর্য... সব মিলিয়ে মোটেই অতুলনীয় বলা যাবে না, যারা তাকে দেখেছে তাদের কাছে খুব আকর্ষণীয়ও মনে হয়নি’। এই দুই ঐতিহাসিকের কারো বর্ণনাই সমসাময়িক নয়, কাজেই একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে আমলে নেওয়ারও কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

ওদিকে, কোনো আবক্ষ প্রতিমাও নেই যাকে ক্লিওপেট্রার প্রামাণ্য উৎস হিসেবে গণ্য করা যায়, তবে হ্যাঁ পুরোপুরি ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পেয়ে প্রত্নবিদদের হাতে পড়েছে, তাঁর এমন বেশ কিছু তসবির পাওয়া যায়, যা অঙ্কিত ছিল প্রাচীন মুদ্রায়। মুদ্রার ওসব প্রতিকৃতিতে, যে নারীকে অঙ্কিত করা হয়েছে সে যেকোনো অঞ্চলের হতে পারে, দেখতে গড়পরতা, বক্র-নাক আর পুরুষালী। তবে এর বিশ্লেষণে একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে, প্রাচীন বিশ্বে মুদ্রা ছিল প্রচারণার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। যে কারণে ধারণা করা হয় কমবয়সী রানী হিসেবে ক্লিওপেট্রাকে আইনসিদ্ধভাবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশেই অন্যান্য টলেমি শাসকদের চেয়ে তাকে ভিন্নরকম না দেখিয়ে বরং তার মুখমণ্ডলে পূর্বসুরীদের মতো পুরুষালী ভাবই বজায় রাখার চেষ্টা হয়েছে।

সৌন্দর্য বিষয়েও এখানে একটা ব্যাপার আমলে নিতে হবে, এটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণও, এখনকার আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বের সৌন্দর্য চিন্তার বিপরীতে প্রাচীন সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। উদাহরণ দেওয়া যায়, প্রাচীন গ্রিকরা তাদের প্রেমের দেবী আফ্রোদিতিকে সব সময় অপরিবর্তনীয়ভাবে চিত্রিত করেছে পূর্ণদেহী খাড়ানাকের এক নারী হিসেবে এ সময়ের আধুনিক সমাজ পুষ্ট শরীরের এই নারীকে কাছে পেলে প্রথমেই পরামর্শ দেবে তার দেহের খানিকটা ওজন কমানোর ও প্লাস্টিক সার্জারি করে নাক পুনর্গঠনের! কাজেই এ সময়ের বিবেচনায় ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্য বিচার করাটা এক রকম নির্থক, ইতিহাসে ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্য আসলে নির্ণিত হয়েছে ওই সময়কার সংস্কৃতির সৌন্দর্য ধারণার আলোকেই।

আরেকটা কায়দাও অনুসরণ করা যেতে পারে, তার সৌন্দর্যের বিচার করা যেতে পারে পুরোপুরি শরীরী আবেদনের দৃষ্টিকোণ থেকে। ক্যাসিয়াস দিও অবশ্য এ কথাও বলেছেন যে, ‘ক্লিওপেট্রার কণ্ঠস্বরে এমন সরসতা ছিল, এবং কথার প্যাঁচে সে যে কাউকে তার মতের স্বপক্ষে নিয়ে আসতে পারতো’। একইভাবে অন্য ঐতিহাসিক প্লুটার্ক জানাচ্ছেন— ‘ক্লিওপেট্রার বাচনভঙ্গিতে ছিল অপ্রতিরোধ্য এক আকর্ষণ, তার উপস্থিতি, তার বক্তৃতা অন্যদেরকে সহজেই মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলতো’। তিনি আরেক জায়গায় বলছেন— ‘তার কণ্ঠে এক ধরনের মিষ্টতা ছিল; আবার তার এই কণ্ঠই ছিল তার বড় অস্ত্র, এই অস্ত্রে ইচ্ছেমতো ভাষা যোগ করতে তার কোনো কুণ্ঠা ছিল না’।

তাহলে বার্তা কিন্তু খুব পরিষ্কার— ক্লিউপেট্রার মোহনীয়তায় তার শরীরী সৌন্দর্যের চেয়ে মুখ্য ছিল তার বুদ্ধিমত্তা, মানসিক গুণ এবং, আপাতদৃষ্টিতে স্পষ্ট হওয়া তার কণ্ঠক্ষমতা। এখন ক্লিওপেট্রার জন্য দুই গ্রিক বীর সিজার আর অ্যান্টনির প্রণয় উপাখ্যানের ব্যাখ্যা তাহলে কী? সিজার আর অ্যান্টনির ক্লিওপেট্রার প্রতি তাদের প্রণয়-গভীরতা নিয়ে পর্যলোচনা করলে এটা বেশ ভালোভাবেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এই খেলায় ওই দারুণরকম যৌনাবেদনময়ী তরুণীর শরীরের চেয়ে আরো অন্য কোনো ব্যাপারও যে কাজ করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ ইতিহাস এই সাক্ষীও দেয় সিজার ও অ্যান্টনি কেউ-ই সুবোধ প্রেমিকটি ছিল না, নারীবাজ হিসেবে বরং তাদের দুজনেরই গগনচুম্বি খ্যাতি ছিল। কাজেই ক্লিওপেট্রার যৌনাবেদনে সাড়া দিয়ে তারা তার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে এই হিসেব ধোপে টিকে না।

বরং ইতিহাসের নানা সূত্র ঘেটে এরকমই প্রতীয়মান হয়— ক্লিউপেট্রার শারীরিক সৌন্দর্য বা আকর্ষণ পাশের মেয়েটির চেয়ে খুব বেশি আহামরী কিছু ছিল না, কিন্তু তার চারিত্রিক চাতুর্য, মোহনীয়তা আর দুঃসাহসীকতায় সহজেই মুগ্ধ হয়েছে বা বশ মেনেছে প্রাচীন দুনিয়ার বেশিরভাগ বাঘা বাঘা পুরুষ, কিন্তু গ্রিকদের একপেশে ইতিহাস, আর যুগ যুগ ধরে নানা কল্পনাবিলাসীর তুলির আঁচড়ে এখন পর্যন্ত ক্লিওপেট্রা চিত্রিত হয়ে আছে তাবৎ নারীকুলের মধ্যে সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিমা হিসেবেই। এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠায় চলচ্চিত্র বড় একটা ভূমিকা পালন করেছে। এখনও অনেকের কাছে ক্লিওপেট্রার চেহারা ধরা আছে লিজ টেলরের ওই মাংশল বর্তুল মুখাকৃতিই। হালে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে ক্লিওপেট্রা হিসেবে নবতর সংযোজন হিসেবে আসছে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। অর্থাৎ আরেকদফা কল্পনার রঙে অনন্য হয়ে উঠেবে প্রচলিত উপকথার ক্লিওপেট্রা, বাস্তবের ক্লিওপেট্রা সে হবে না কিছুতেই। তারপরও জয়তু ক্লিওপেট্রা, জয়তু তার সেক্স অ্যাপিল!

0 Comments