‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’


‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’—অর্থাৎ এক অঞ্চল এক পথ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর চীন। চীনের সঙ্গে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অন্তত ৭০টি দেশের জলে ও স্থলে সংযোগ স্থাপনের (কানেকটিভিটি) পরিকল্পনা এটি। আছে এসব অঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণ, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও বাণিজ্য বাড়ানোর নানা পরিকল্পনা। স্থলভিত্তিক সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট এবং সমুদ্রগামী মেরিটাইম সিল্ক রোড এই উদ্যোগের অন্তর্ভুক্ত। 

ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডকে সংক্ষেপে ‘ওবর’ অথবা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ ইনিশিয়েটিভও বলা হচ্ছে। প্রকল্পটিতে অর্থায়নের জন্য এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইটি) নামে চীনের নেতৃত্বে ১০ হাজার কোটি ডলারের মূলধনে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ ছাড়া চার হাজার কোটি ডলারের সিল্ক রোড তহবিল গঠন করেছে চীন। 

এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে দেশটি। প্রকল্পটির ব্যাপারে চীনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছে ৪৪টি দেশের সমঝোতা স্মারক। চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত দেশগুলোকে আগ্রহী করে তোলার জন্য এর মধ্যে ২০টিরও বেশি দেশ সফর করেছেন। এই নতুন রুটের চীনা স্বপ্নদ্রষ্টা তিনিই। ২০১৩ সালের অক্টোবরে বিশ্বের সামনে তিনি এই পরিকল্পনা তুলে ধরেন। বর্তমানে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড বা ওবিওআর বিশ্বের একটি আলোচিত বিষয়।

ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড কী?

‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ মহাপরিকল্পনার আওতায় রয়েছে ৭০টি দেশের সঙ্গে চীনের মূল ভূখণ্ড সংযুক্ত করা। মহাপরিকল্পনাটির অংশ মূলত দুটি। এক. সড়কপথে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত হবে চীন। চীন সড়কপথের সঙ্গে রেলপথ ও তেলের পাইপলাইনও সংযুক্ত করছে। একই সঙ্গে সমুদ্রপথেও, বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হবে চীন। 

প্রাচীন সিল্ক রুটের আধুনিক সংস্করণ এটি। মূল সিল্ক রোডের অস্তিত্ব ছিল আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে, এটা ছিল বাণিজ্যের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ। এর মধ্য দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিনিময় হয়েছে। চীনের নতুন ‘সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’ ও ‘টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি মেরিটাইম সিল্ক রোডও’ একই কাজ করবে। নতুন নতুন ও উন্নততর অবকাঠামো নির্মাণের মধ্য দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংস্কৃতি ও চিন্তার প্রসার হবে, ফলে সবারই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে।

সরকারিভাবে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের যে মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখা যায়, চীনের সিয়ান থেকে উরুমকি, তুরস্কের ইস্তাম্বুল ও ইউরোপের স্পেনের মাদ্রিদ পর্যন্ত সড়কপথ তৈরি হবে, যা কি না মধ্য এশিয়ার কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান হয়ে মস্কো, পোল্যান্ড, জার্মানির হামবুর্গ, হল্যান্ডের রটারডাম হয়ে মাদ্রিদে গিয়ে শেষ হবে।

দুই. একই সঙ্গে চীন একটি মেরিটাইম তথা সামুদ্রিক সিল্ক রোডের মহাপরিকল্পনা করছে। এই সিল্ক রোডের মাধ্যমে একদিকে আফ্রিকার জিবুতি, কেনিয়ার মোমবাসা বন্দরের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর ও মিয়ানমারকেও যুক্ত করতে চায় চীন।

‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ সম্মেলন

১৪ মে চীনের পেইচিংয়ের গ্রেট হলে বসে দুই দিনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ সম্মেলন। প্রথম দিন বিশ্বজুড়ে যোগাযোগব্যবস্থা পুনর্গঠন প্রকল্পে ১২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয় চীন। এই মেগা প্রকল্পে যে কেউ চাইলে অংশ নিতে পারবে বলে জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং। 

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেসহ শতাধিক দেশের সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান, প্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী দলের সদস্যরা অংশ নেন সম্মেলনে। সম্মেলন বয়কট করেছে ভারত। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও পাকিস্তান এই সম্মেলনে অংশ নেয়।

শি চিনপিং বলেন, ‘আমরা বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প বাস্তবায়নকে এ অঞ্চলে শান্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করছি। উন্মুক্ত উন্নয়নকে উৎসাহিত করা এবং সুষ্ঠু, যৌক্তিক ও স্বচ্ছ বিশ্ববাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিধিব্যবস্থা গড়ে তোলার এখনই সময়। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা কিংবা আমেরিকা—যেখানকার দেশই হোক না কেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকল্পনায় তাদের সবারই সহযোগিতা ও অংশীদারত্ব থাকবে।’

প্রস্তাবিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বাস্তবায়িত হলে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে ঐক্য আরো জোরালো হওয়ার পাশাপাশি এ অঞ্চলের অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হবে বলে মন্তব্য করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র তৈরি ও বিশ্বায়নে অবদানের জন্য চীনের প্রশংসা করেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।
 
কুনমিং থেকে কক্সবাজার

এশিয়ার অর্থনীতি পাল্টে দিতে পারে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প। চীন দুটি ‘ইকোনমিক করিডর’ সৃষ্টি করছে। একটি কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ। দ্বিতীয়টি চীনের জিনজিয়াং থেকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের সমুদ্রবন্দর গাওদার পর্যন্ত রেল ও সড়কপথ। এই অর্থনৈতিক করিডরের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। পাকিস্তানের অভিযোগ, ভারত ওই অর্থনৈতিক করিডরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে।

যে কারণে উদ্বিগ্ন ভারত

চীনের এই প্রকল্প নিয়ে নয়াদিল্লির শাসকদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। এর কারণ প্রধানত তিনটি। প্রথমত, এর মাধ্যমে এ অঞ্চলের দেশগুলোতে চীনের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব বাড়বে। দ্বিতীয়ত, ভারতের চিরবৈরী পাকিস্তানে এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করা হবে। তৃতীয়ত, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগরে চীনের উপস্থিতি বাড়বে। 

এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের বন্দর উন্নয়নে চীন বিপুল বিনিয়োগ করবে। এর মধ্যে চীনের ১.৪ বিলিয়ন ডলারের সহায়তায় শ্রীলঙ্কার পোর্ট সিটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ভারতের আশঙ্কা, এই প্রকল্পের অজুহাতে চীনা সাবমেরিন পাকিস্তানের গাওদার বন্দরে অবস্থান করবে এবং চীন পারস্য উপসাগরে নজরদারি করবে। 

এই জলরাশি ব্যবহার করে বিশ্বের পরিবহন জাহাজের বেশির ভাগই ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ায় যাতায়াত করে। ওবিওআর প্রকল্পে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে সড়ক যাবে বলে শুরু থেকেই নয়াদিল্লি এর বিরোধিতা করে আসছে। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরকে নিজেদের অংশ দাবি করে ভারত।

বাংলাদেশ কি লাভবান হবে?

২০১৭ সালকে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ‘বন্ধুত্ব ও আদান-প্রদানের’ বছর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর যে লক্ষ্য বাংলাদেশের রয়েছে, তা অর্জনে এটা ‘গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ’ নিয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। 

দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ তৈরিতে বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার বা বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডর নিয়েও কাজ করছে পেইচিং। এই উদ্যোগের পাশাপাশি শিল্পায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিনিয়োগ, সমুদ্র খাত সহযোগিতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা এবং সংস্কৃতি ও দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি নিয়ে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে। এ ছাড়া চীন-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করবে উভয় পক্ষ।

সমালোচনাও আছে

চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড নিয়ে সমালোচনাও আছে। বলা হয়, চীন এই উদ্যোগের মাধ্যমে তার অর্থনীতির জন্য সর্ববৃহৎ ট্রেড প্রকল্প করতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অনেক দেশ তার পণ্য নিয়ে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। এ প্রকল্পের মাধ্যমে চীন বিশ্বে আরও বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষ এ সমালোচনা মানতে নারাজ। 

তাদের মতে, যেকোনো দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন করতে হলে অবকাঠামোর উন্নতি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে চীন দেশগুলোকে সহায়তা করছে। এটাই চীনের নীতি। এতে উভয়ই লাভবান হবে। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে চীনের বড় আগ্রহ রয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে এই মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোও উপকৃত হতে পারে।

0 Comments