অপারেশন রুমকে “অপারেশন থিয়েটার” বলা হয় কেন?


অপারেশন থিয়েটার কথাটা আমরা সচারচার বলে থাকি। এটা আমাদের কাছে স্বাভাবিক বলেই মনে হয় কিন্তু আমাদের মনে কি কখনও প্রশ্ন জাগে না কথাটা কি সঠিক? শব্দ দুইটিকে কি দুই রকম মনে হয় না অপারেশন আর থিয়েটার? অপারেশন রুম বলতে আমাদের মনে হয় ছুরি, কাচি বিভিন্ন অপারেশন সম্পর্কিত জিনিসপত্রে ভর্তি একটা রুম। যেটা থাকে রোগ-জীবাণু মুক্তত।

এখানে প্রবেশের অনুমতি ডাক্তার, নার্স ব্যাতীত অর্থাৎ যারা চিকিৎসা পেশার সাথে যুক্ত তারাই এখানে যেতে পারে। এমনকি রোগীর কোন স্বজনকেও এখানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। অন্যদিকে থিয়েটার শব্দটির অর্থ নাট্যশালা বা অভিনয় মঞ্চ বা উন্মুক্ত গ্যালারি। 

থিয়েটার শব্দটা শুনে আমাদের মনে জাগে এমন একটা জায়গার ছবি যেখানে নাটকে অভিনয় করা হয় এবং বিভিন্ন উপন্যাসের উপর নির্মাণ করা হয় যাত্রাপালা। আর সারি সারি সিটে বসা দর্শকরা অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে হাত তালিতে অভিনন্দন জানায় তাদের। তাহলে কেন অপারেশন রুমকে অপারেশন থিয়েটার বলা হয় সে সম্পর্কে আমরা আজ জানব।

অতীতে অপারেশন রুমগুলো রীতিমতো থিয়েটারের মতে করেই তৈরি করা হতো। বড় একটা গ্যালারি থাকত রুমের সাথে। রুমের চারপাশ ঘিরে থাকত দর্শকরা। এখন প্রশ্ন আসতে পারে দর্শকরা কেন অপারেশন করা দেখত? আসলে এখানে দর্শক বলতে টিকিট কেটে সিনেমা দেখা দর্শকদের বোঝানো হয় নি।

এখানে দর্শকদের সারিতে থাকতেন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা। চিকিৎসকরা মেডিকেল ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানোর জন্য তাদের দিয়ে অস্ত্রোপচার চালাতেন এবং দর্শকদের সারিতে বসতেন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা এজন্য তখন অপারেশনের রুমকেকে থিয়েটার নামকরণ করা হয়।
  
১৯৬০ এর দশকেকে এমন অপারেশন থিয়েটারের সংখ্যা বাড়তে থাকে।কারণ প্রাচীন কালে মেডিকেলের অপারেশন থিয়েটারগুলো একেকটা গ্যালরি বা এম্ফিথিয়েটারের ন্যায় তৈরি হতো।

খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ সালের আগে অস্ত্রোপচার সম্পর্কে কারো কোন ধারণই ছিল না। মিশরীরা প্রথম মাথার খুলিতে ড্রিল করে ট্রেফিনেশন পদ্ধতি আবিষ্কার করে অস্ত্রোপচার চালায়। তখন এ অস্ত্রোপচারের সময় তারা কোন ধরনের হ্যান্ড গ্লভস ব্যবহার করতেন না। শুধু রক্তের দাগ এড়ানোর জন্য পোশাকের উপর এপ্রোন পরতেন। ব্যবহার করা হত না কোন রুম। ছিল না কোন অ্যানেস্থেসিয়ার ব্যবস্থা। রোগীর হাত-পা বেঁধে অপারেশন করা হতো যেন রোগী ব্যাথায় নড়া-চড়া করতে না পারে।

খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ সালে ব্যবিলিয়ন সভ্যতার সময় হামমুরবির আইন অনুযায়ী, উচ্চ-শ্রেনীর ব্যক্তির জীবন বাঁচাতো অক্ষম সার্জনকে ছুরির আঘাতে একটি হাত কেটে নেয়ার নির্দেশ ছিল। এই ভয়ে তখনকার চিকিৎসকরা রোগীর জীবন বাঁচাতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন আনেন।
  
১৮৮৪ সালে জার্মান সার্জন গুসতাভ নিউবের তার নতুন আবিষ্কৃত অটোক্লেভ মেসিন দিয়ে স্টেরিলাইজাইড অপারেশনের সাথে পরিচয় করান। ১৮৮৫ সালে তিনি একটি প্রাইভেট হাসপাতাল তৈরি করেন। যেখানে অপারেশনের রুমের দেয়াল, মেঝে এবং ডাক্তাররা হাত, মুখ মারকারি ক্লোরাইড দিয়ে পরিষ্কার করতেন।

তিনি সংক্রামিত রোগের রোগীদের অপারেশনের জন্য আলাদা অপারেশন থিয়েটারের প্রচলন করেন।১৮৯০ সালে উইলিয়াম হালস্টেড হাতের গ্লভস আবিষ্কার করেন।

১৯০০ সালে খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনা সার্জন হুয়া টু ও প্রথমবারের মতো অস্ত্রোপচারের জন্য অ্যানেস্থেসিয়া প্রবর্তন করেন।এরপর থেকে কাটা ছেঁড়ার সময় রোগীরা আর ব্যাথা অনুভব করতেন না।

১৯ শতকের পর থেকে প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের অপারেশন থিয়েটার গুলোতে ও পরিবর্তন এসেছে। রোগীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বাইরের কাউকেই আর অপারেশন রুমে থাকতে দেওয়া হয় না।

বর্তমান সময়ে শুধু অপারেশন থিয়েটার নয় চিকিৎসার যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। এখন অপারেশন রুমের সাথে নেই কোন গ্যালারির ব্যবস্থা। ছাত্রদের ও এখন আর গ্যালারিতে বসে অপারেশন দেখতে হয় না। আগের সেই অপারেশন থিয়েটারের অস্তিত্ব এখন আর খুজে পাওয়া যাবে না। আর যা আছে তা এখন পরিণত হয়েছে জাদুঘরে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে কিছু কিছু মানুষের বিশেষ অবদানের জন্য আমরা পেয়েছি আজকের এই উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা। এসব মানুষের কাছে আমরা আজীবন ঋণী থাকব।

0 Comments