১) বরিশাল গানস/গানস অব বরিশাল
বরিশাল গানস বলতে সাধারণত ঊনবিংশ শতাব্দীতে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বরিশালের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যে বিকট কিছু শব্দ শুনা যেত তাদেরকে বোঝায়। বিকট এ শব্দের সাথে ঢেউয়ের শব্দের চেয়ে কামানের গোলা দাগার শব্দের বেশি মিল ছিল বলে জানা যায়। কখনও কখনও একটা, আবার কখনও দুই বা তিনটি শব্দ একসাথে শোনা যেত। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল থেকে শব্দগুলো বেশি শোনা যেত। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত শব্দগুলো বেশি শোনা যেত । প্রথমে ব্রিটিশরা মনে করত এ শব্দগুলো জলদস্যুদের কামান দাগার, কিন্তু বহু অনুসন্ধান করেও এর কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি।
বরিশাল গানস কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল সে সম্পর্কে বেশ কয়েকটি অনুমিত ধারণা রয়েছে, তবে এদের কোনটিই সঠিক ভাবে প্রমাণিত হয় নি। অনেকে এটাকে ভূমিকম্প, বজ্রপাত, মোহনায় ঢেউয়ের ধাক্কা প্রভৃতির সাথে তুলনা করেছেন।
বরিশালের মত পৃথিবীর আরও কিছু এলাকায়ও এ ধরনের শব্দ শোনা গেছে বলে জানা যায়। বিভিন্ন নথিপত্র থেকে ১৮৭০ সালের দিকে প্রথম বারের মত বরিশাল গানসের কথা জানা যায়। ১৮৮৬ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, হরিশপুর প্রভৃতি স্থানে এ শব্দ শোনা গেছে বলে জানা যায়। অনেকের মতে ১৯৫০ সালের এর পরে এই শব্দ আর কেউ কখনো শোনেনি।
২) চিকনকালা/নিফিউ পাড়া
মায়ানমার সীমান্ত ঘেঁষা বাংলাদেশের অন্যতম উঁচু আর সবচেয়ে দুর্গম গ্রামগুলোর একটি ‘চিকনকালা’। চিকনকালা গ্রামের বসতিদের অধিকাংশই আদিবাসী মুরং বা ম্রোরা সম্প্রদায়ের। তবে এরা কিন্তু খুব চমৎকার উপভোগ্য মানুষ। কখনো যদি আপনি ওই এলাকায় ঘুরতে যান আপনার মনে হতে পারে এই অঞ্চলটি একদমই যেন পৃথিবীর বাইরে। মুরং সম্প্রদায়ের গ্রামটির অবস্থান ঠিক বাংলাদেশ-বার্মা নো-ম্যানস ল্যান্ডে। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৭০০ ফুট ওপরে অবস্থিত।
গ্রামের লোকজনের মতে, এই বনে অতৃপ্ত অপদেবতা বাস করেন। প্রতিবছরই হঠাৎ একদিন কোনো জানান না দিয়ে বনের ভেতর থেকে অদ্ভুত একটি ধুপধাপ আওয়াজ আসে। আর এই আওয়াজ শুনলে গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই আতঙ্কে জমে যান। তারা তখন মনে করেন, পিশাচের ঘুম ভেঙেছে। এটিই সে আওয়াজ করছে। বনের ভেতরে থাকা কাঠুরে বা শিকারির দল তখন ঊর্ধ্ব শ্বাসে নিজের জীবন হাতে নিয়ে বন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিবছরই তাদের এক-দু’জন পেছনে রয়ে যায়। তারা নাকি আর কোনোদিন গ্রামে ফিরে আসে না। বেশ ক’দিন পরে হয়তো জঙ্গল থেকে তাদের মৃতদেহ আবিষ্কার হয়। সারা শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। কিন্তু কি দেখে ভয় পেয়েছে, আর কিভাবে কোনো ক্ষতচিহ্ন ছাড়া মারা গেছে সেই রহস্য এখনো চিকনকালার লোকজন ভেদ করতে পারেনি।
৩) লালবাগ কেল্লার সুড়ঙ্গ
বাংলাদেশেরর মানুষের কাছে খুবেই পরিচিত একটি দুর্গ লালবাগ কেল্লা। ছোট বেলা থেকেই বইপত্রে বিভিন্ন সময় লালবাগের অনেক ইতিহাস পড়তে পড়তে বড় হয়েছেন। কিন্তু এই লালবাগ নিয়ে আছে অনেক রহস্য যা অনেকেই জানেন আবার অনেকেই জানেন না। শোনা যায় লালবাগ কেল্লায় নাকি এমন একটি সুড়ঙ্গ আছে যার ভেতরে কেউ প্রবেশ করে আজ পর্যন্ত ফেরত আসতে পারেনি। লালবাগ কেল্লার নিচ দিয়ে অনেকগুলো সুড়ঙ্গ আছে, যেগুলো জমিদার আমলে করা। জমিদাররা বিপদ দেখলে সেই সব পথে পালিয়ে যেতেন। তেমনই একটা সুড়ঙ্গ আছে, যার ভেতরে কেউ ঢুকলে তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না।
পরীক্ষা করার জন্য একবার ২টা কুকুরকে চেইনে বেঁধে সেই সুড়ঙ্গে নামানো হয়েছিলো। চেইন ফেরত আসে কিন্তু কুকুর দুটো ফিরে আসে নি। সুড়ঙ্গটি মোঘল আমলে বানানো হয়। তখন এটি এখন যেমনটা দেখা যায় তেমনটা ছিলনা। শোনা যায়, কিছু বিদেশী বিজ্ঞানীরা গবেষণা করার জন্য কুকুর পাঠায়, কিন্তু সে কুকুর আর ফিরে আসেনি! পরে তারা চিন্তা করে শেকল দিয়ে বেধে কুকুর পাঠায়, কিন্তু সেখানে কুকুরের শিকল আসলেও কুকুরের চিহ্ন পাওয়া যায়নি!
কারো কারো মতে, এখানে এমন এক গ্যাস আছে যাতে প্রাণীর মাংস খসে গলে যায়, কারো মতে এখানে এমন এক ভয়ংকর শক্তি আছে যার কারণে কেউ প্রবেশ করলে আর ফিরে আসবে না! আর একটা কথা, এখানে এতটাই অন্ধকার যে কোন লাইট বা আলো কাজে আসেনা। এখন এটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কেউ যদি কেল্লায় যান তবে পাহাড়ের উপরে উঠলেই দেখতে পাবেন।
লালবাগ কেল্লার রহস্যময় এ সুড়ঙ্গ তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় যে সুবেদার আজম শাহ ১৬৭৮ সালে ঢাকায় একটি প্রাসাদ দুর্গ নির্মাণে হাত দেন। তখন ঢাকার সুবেদারদের থাকার জন্য স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা ছিল না। স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করতে আসা সুবেদাররা ঢাকায় স্থায়ী ভবন নির্মাণে কোনো উৎসাহ দেখান নি। যুবরাজ আযম শাহ প্রথম এই উদ্যোগ নেন। তিনি অত্যন্ত জটিল একটি নকশা অনুসরণ করে দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেন। তিনি দুর্গের নামকরণ করেন কিল্লা আওরঙ্গবাদ। কিন্তু পরের বছর সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁকে দিল্লী ফেরত পাঠান। ফলে দুর্গের কাজ অসমাপ্ত রেখে তাঁকে দিল্লী চলে যেতে হয়। এরপর সুবেদার হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা আসেন শায়েস্তা খাঁ। যুবরাজ আযম শাহ তাঁকে লালবাগ দুর্গের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য অনুরোধ করেন। শায়েস্তা খাঁ দুর্গের কাজ পুনরায় শুরু করেন। কিন্তু ১৬৮৪ সালে তাঁর অতি আদরের মেয়ে পরি বিবি অকস্মাৎ মারা গেলে তিনি অশুভ মনে করে এর নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন। এর পরিবর্তে নির্মাণ করেন চিত্তাকর্ষক পরি বিবির সমাধিসৌধ।
৪) সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড
“নো গ্রাউন্ড” মানে অতল স্পর্শী। রহস্যময় এ খাতকে বহু আগে ব্রিটিশরা “সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড” নামে আখ্যায়িত করে। এর কারণ হলো সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড যেখানে শুরু সেখানে হঠাৎ করেই পানির গভীরতা বেড়ে গেছে , সাগরের তলদেশের রহস্য। এটি খাদ আকৃতির সামুদ্রিক অববাহিকা বা গিরিখাত, যা বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানকে কৌণিকভাবে অতিক্রম করেছে। এটি গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত। গঙ্গা খাদ নামেও এটি পরিচিত। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের আরও কিছু বদ্বীপ-মুখী খাদ দেখতে পাওয়া যায়। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের প্রস্থ ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার, তলদেশ তুলনামূলক ভাবে সমতল এবং পার্শ্ব দেয়াল প্রায় ১২ ডিগ্রি হেলানো। মহীসোপানের কিনারায় খাদের গভীরতা প্রায় ১,২০০ মিটার।
ধারণা করা হয়, বঙ্গোপসাগরের নিচে কান্দা ও উপ-বদ্বীপ উপত্যকার আকারে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড সাগর অভিমুখে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার সম্প্রসারিত হয়ে আছে। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের দিকে মুখ করে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের মোহনার কাছে বালুচর ও শৈলশিরার অবস্থিতি এই ইঙ্গিতই বহন করে যে, এই খাদ দিয়েই পলল বঙ্গোপসাগরের গভীরতর অংশে বাহিত হয়।
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের উৎপত্তি নিয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে। অবশ্য সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে যে, সোপান প্রান্ত ও সোপান প্রান্তের ঊর্ধ্ব ঢালে উৎপন্ন ঘোলাটে স্রোত ও নদী-প্রবাহের সম্মিলিত প্রভাব সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড গঠনের জন্য দায়ী।
৫) বগালেক
বান্দরবান জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান বগালেক। অত্যাশ্চর্য এই হ্রদটি পাহাড়ের চূড়ায় সমুদ্র পৃষ্ট থেকে প্রায় ১৭০০ ফুট উপরে ১৫ একর জায়গা জুড়ে জলরাশি সঞ্চিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে। বম ভাষায় বগা মানে ড্রাগন। পাহাড়ের কোলে ম্রো, বম, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা প্রভৃতি নৃগোষ্ঠীর মানুষ বাস করত।
স্থানীয় পাহাড়ি মানুষদের মতে বহু কাল পূর্বে এখানে একটি চোঙা আকৃতির পাহাড় ছিল। দুর্গম এ পাহাড়টি ছিল ঘন অরণ্যে ঢাকা। সেই পাহাড়ের নিকটবর্তী গ্রামগুলো থেকে প্রায়ই গবাদিপশু আর ছোট শিশুরা ওই পাহাড়টিতে গিয়ে আর ফিরে আসতো না! অতিষ্ঠ গ্রামগুলো থেকে সাহসী যুবকদের একটি দল এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখতে পায়, সেই পাহাড়ের চূড়ার গর্তে ভয়ঙ্কর দেখতে এক বগা/ড্রাগন বাস করছে। তখন তারা সে ড্রাগনটিকে সেখানে মেরে ফেলে। কিন্তু ড্রাগনটির মৃত্যুর সাথে সাথে তার গুহা থেকে ভয়ঙ্কর গর্জনের সাথে বেরিয়ে আসে একটি আগুনের লেলিহান, যা আশপাশ পুড়িয়ে দেয়। আর চোখের পলকেই তখন পাহাড়ের চূড়ায় সৃষ্টি হয় সেই মনোরম লেকের।
0 Comments